বাসিলিকা সিস্টার্নঃ মাটির নিচে রহস্যপুরী

basilica cistern istanbul
Dec. 23, 2024

ইস্তাম্বুলের অন্যতম একটি আকর্ষণ কেন্দ্র হলো বাসিলিকা সিস্টার্ন। আয়া সোফিয়ার বিপরীত পাশে মাটির নিচে এক রহস্যময় বিশাল জলাধার। ৫৪২ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনে পর মাটির নিচে থাকা এই বিশাল জলাশয় হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। কয়েকশত বছর পর এটি সংস্কার করে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।

 

সময়টা ১৫৬৫। ইস্তাম্বুলে ঘুরতে আসা এক ফরাসি পর্যটক পেট্রাস গেলাস একটি অবাক বিষয় খেয়াল করলেন। তিনি দেখলেন ইস্তাম্বুলের কিছু বাড়ির মানুষেরা পানির জন্য বাইরে যায় না। তাঁরা তাঁদের বাসার নিচের একটি ছিদ্র থেকে বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় সব পানি সংগ্রহ করে। তিনি বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে এই আশ্চর্য কাহিনী লিখে গেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে বাড়ির নিচে এক বিশাল জলাধার  রয়েছে। সেখানে রয়েছে অসংখ্য কলাম। সেখানে মাছও রয়েছে। পাহাড়ের উপরে অবস্থিত বাড়ির নিচে কোথা থেকে আসলো এতো পানি?

 

আয়া সোফিয়ার ঠিক উল্টোপাশে মাটির নিচে অবস্থিত এই সিস্টার্ন থেকে পানি সরবরাহ করা হতো কনস্টান্টিনোপলের গ্রেট প্যালেস পাশের এলাকায় পানি সরবরাহ করা হতো। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুল শহর ইতিহাসে অনেকবার বহি:শত্রুর আক্রমণ  অবরোধের শিকার হয়। ফলে অবরোধকালীন সময়ে পানির সংকট মেটাতে বাইজেন্টাইনরা মাটির নিচে অনেকগুলো গোপন জলাশয় নির্মাণ করে। সেগুলোর অবস্থান মানচিত্র অল্প কিছু সরকারী কর্মকর্তা জানতো।

 

১৪৫৩ সালে বাইজেন্টাইনরা যুদ্ধে পরাজিত হলে সেই মানচিত্রগুলো হয়তো তাঁরা নষ্ট করে ফেলেছে। ফলে এই জলাশয়ের নেটওয়ার্কের সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেনি ওসমানীরা। আবার তাঁদের অবরোধের কোন ভয় ছিল না। মুসলমানরা দীর্ঘদিন জলাশয়ে আবদ্ধ পানিকে পবিত্র মনে করে না। ফলে এসব জলাশয়ের পানি নিয়ে তাঁদের কোন আগ্রহও ছিল না। ফলে কয়েক শতাব্দির জন্য মাটির নিচেই লুকিয়ে থাকে এসব সিস্টার্ন। তবে পরবর্তী সময়ে নতুন ভবন নির্মানের সময় ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন এলাকায় মাটির নিচে পাওয়া যায় এমন সিস্টার্ন। এগুলো আবার একটার সাথে আরেকটার কানেকশন আছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া সিস্টার্নের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো বাসিলিকা সিস্টার্ন।

 

এই সিস্টার্নটি লম্বায় ১৪৩ মিটার ৬৫ মিটার প্রশস্ত। ৩৩৬ টি মার্বেলের স্তম্ভের উপর সিস্টার্নের ছাদটি স্থাপন করা হয়েছে। ১২ টি সারিতে ২৮ টি কলামে বিন্যস্ত স্তম্ভগুলো। সবচেয়ে রহস্যময় হলো দুটি কলামের নিচে দেখা যায় দুটি মাথা। মাথা দুটি রোমান দেবী মেসুসার। ধারণা করা হয় কোন প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবেশ থেকে দেবীর মাথা দুটি এনে কলামের নিচে বসানো হয়েছে। তবে জলাশয়ের ঠিক নিচেই কেন দেবী মাথা রাখা হয়েছিল সে প্রশ্নের কোন জবাব মেলেনি আজো।

 

প্রকাণ্ড এই জলাশয়ে ৮০ হাজার কিউবিক পানি সংরক্ষন করা যায়। তবে বর্তমানে অল্প পানি রাখা হয়েছে। অবাক বিষয় এখানে পানি টেনে নিয়ে আসা হতে দীর্ঘ ১৯ কিলোমিটার দূরের বেলগ্রেড ফরেস্টের প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে। ১৫০০ বছর আগে মাটির নিচে দীর্ঘ টানেল বানিয়ে এভাবে পানি নিয়ে আসা নিশ্চয়ই সহজ কোন বিষয় ছিল না।

 

অনেক বছর চাপা পরে ছিলো এই ইতিহাস। ১৯৮৭ সালে ইস্তাম্বুল সিটি কর্পোরেশন সংস্কার সৌন্দর্যবর্ধন করে এটিকে একটি জাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। ২০১৭ সালে আরো একবার সংস্কার করা হয়েছে বাসিলিকা সিস্টার্নের। চমৎকার লাইটিংয়ের মাধ্যমে আলো আধারী এক পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে ঐতিহাসিক অনেক ভাস্কর্য।

 

ইস্তাম্বুলে আসা পর্যটকদের অন্যতম এক প্রধান আকর্ষণ এই মাটির নিচের রহস্যময় জলাধার বাসিলিকা সিস্টার্ন। আয়া সোফিয়ার ঠিক উল্টো পাশে গেলেই চোখে পড়বে বাসিলিকা সিস্টার্নের সাইনবোর্ড। ঘুরে আসুন দেড় হাজার বছর আগের এক প্রাচীন  সিস্টার্ন থেকে।